Header Ads

Header ADS

বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা : বিষাদ আবদুল্লাহর কবিতার ক্যানভাস

 আবু জাফর সৈকত

বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা : বিষাদ আবদুল্লাহর কবিতার ক্যানভাস


ঠাকুর-মওলানা-ফাদার-মানুষজোঁকের দল

কি বুঝাতে চায়! পৃথিবী কি তা বুঝে!

বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকায় এখনো অজস্র ফুল ফোটে


-কবিতাকে এভাবে যিনি বিবেচনা করেন, তাঁর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা পাঠক করতেই পারেন। কবি তাঁর রচিত ‘বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা’ কাব্যে এমনি করেই আমাদের সঙ্গী করে তোলেন। কবি যখন বলেন- ‘আঁধারের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যোদয়ের খবর আসে’ তখনি কবির ভাবনা বিশ্বজগতে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বলছিলাম কবি বিষাদ আব্দুল্লাহ রচিত ‘বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা’ বইটি সম্পর্কে। এ গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে কবির ৫৬ টি কবিতা। চলতি দশকের শেষ সময়ে এসে প্রকাশিত হলো কবির প্রথম কবিতার বই। অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।

কবিতা লেখা সহজ কোনো কাজ নয়। জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। কবিতা জীবনের সঙ্গে নানারকমের রোমাঞ্চকর অনুষঙ্গ জড়িয়ে যায় আপনা থেকেই। সেসব হয়তো একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু করপোরেট পৃথিবী যেখানে কবিকে নিয়ত টানে সেখানে জীবনের দর্শনকে ধারণ করে নিজস্ব চিন্তার জগত তৈরি করাও অত মসৃন নয়। সেই কাজটিই কবি করে যাচ্ছেন নিরন্তর। কবিতাকে যদি মানবজীবনের অনুকৃতি বলি তবে কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু বা সম্পূর্ণ কবিতাগুলোতে গুরুত্ব লাভ করেছে সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন আর রাজনৈতিক সচেতনতা। বাদ যায়নি কবি, ব্যক্তি, পারিপার্শ্বিক চরিত্রসমূহ, তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও রূচিসমূহ।

করপোরেট থাবা আমাকে বিধাব বানিয়ে রেখেছে

কিন্তু আমি তা নই

বিধবা/

বিধবা কবিতায় কবি মূলত নিজের ভিতরের সত্ত্বাকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সারাদিনের পরে যখন রাত নামে, পরিশ্রমে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে কবি ঘরে ফেরেন। কবির আশেপাশের মানুষগুলোও কবির মতোই। তাই ঘামে ভেজা গন্ধ কারোর নাকেই অনুভূতি জাগায় না। মরা লাশের মতোই সব অভ্যস্ত হয়ে যায়। 

অন্যদিকে এক ফর্সা কিশোরী গালে হাত দিয়ে রাজপথের

সোডিয়াম আলোয়ে

জোছনা ভেজা রাত দেখছিলো. . .

সে কাকে খুঁজছিলো!

দ্বন্দ্ধ/

আসলে প্রতিটা কবিতায় প্রত্যেক কবি তার নিজেকেই প্রকাশ করেন। ‘সে কাকে খুঁজেছিলো’ প্রশ্নে আড়ালে আসলে উত্তরটা হবে- কবিকে। কিন্তু বর্তমান কবিরা সহজে ফ্রন্ট লাইনে আসতে চান না। চান না বলেই কবিদের অপ্রকাশ মৃত্যু ঘটে তখন আত্মচিৎকার করা ছাড়া কবির আর কিছু করার থাকে না। আসলে কি তাই? একা নিজেকেই নয়, উত্তর আধুনিক কালের সব কবিদেরই কবি এই দলে ফেলেছেন।

ঘুমের ঘোরে আত্মার চিৎকার শুনি

চিৎকার অর্থ ধরা কি সম্ভব!

প্রকাশে সংশয়

বহু আত্মাদের চিৎকারের অর্থ পড়ে থাকে

উত্তরাধুনিক কালে...

চিৎকার/

তাই জ্যান্ত মানুষের সাথে আড্ডা না দিয়ে লেখক লাশের সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত হন। কবির যতই মুখজুড়ে কবিতা থাক আর বুকজুড়ে আগুন থাকুক, যতই মুখে মার্কস আর লেনিন কিঙবা চে করপোরেট সাবানে গা ধুয়ে পবিত্র হতে হয়।

বর্তমান পুজিবাদ সমাজে সমাজপতিরা সবাইকে পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করে আর তাই পণ্যের প্রচারে সত্যকে আড়াল করে রং-চঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করেন মুনাফার বাজারে। তাই আমজনতার ভাষায় কবিকে বলতেই হয়-

সত্য নয় মিথ্যা আমাকে বাঁচায়

অন্যদিকে অনুশোচনা আমাকে পোড়ায়

সত্য/

সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে, মোড়কের প্রেমে পড়েন কবি। নিজেকেও মোড়কে সাজান। বিক্রি করেন নিজেকে স্বল্প দামে দুটো ভাতের চিন্তায়। 

সিদ্ধান্ত একা নিতে পারি না বলে নিজেকে বিক্রি করি

যেন আমি মোড়কজাত পণ্য, স্বল্প দাম, হাত বাড়ালে পাওয়া যায়

  মোড়কজাত পণ্য/

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়, রাজনৈতিক পরিবেশে আমরা সকলেই হাত পা বাধা অবস্থায় পড়ে রয়েছি। আমাদের মুখ আছে বলতে পারি না, আমাদের হাত আছে আমরা সত্যটা লিখতে পারি না, আমাদের চোখ আছে কিন্তু আমাদের দেখা নিষেধ। এমন একটা অবস্থায় নতুন প্রভুদের দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে আক্ষেপ করে তাই কবি বলেন-

আমার কিচ্ছু করার নেই!

শহরে কোন চাঁদ নেই/

কিন্তু একজন কবির দর্শন কখনো এটা হতে পারে না। কবি কখনো দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। পথ যদি দেখাতেই হয় তো সেই পথ দেখাবেন কবি। পুজিবাদ আর বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে কবিকে নতুন তন্ত্রের ধারস্ত হতে হয়। সমস্ত তন্ত্র বাদ দিয়ে কবি তাই সমাজতন্ত্রে আমা খুঁজে পান।

পৃথিবী যে তন্ত্রমন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে রক্তজলের সমুদ্রে অবস্থান করছে, তাতে কি মুক্তি মিলছে! সমস্ত তন্ত্রের ভিতর রক্তের থৈ থৈ জল। কি ভাবছো! নিঃশ্বাসের গতির দিকে তাকাও! সোজা মনের দিকে, তোমার পৃথিবী কেমন হবে! ঠিক করে নাও!

সমস্ততন্ত্র/

শেষ পঙক্তিগুলোতে বিস্ময় চিহ্নের ব্যবহার পাঠককে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। আসলে বর্তমান সময়টাই যাচ্ছে সংশয়ের মধ্য দিয়ে। যেখানে একজন ব্যক্তির আঙুলি হেলনে চলছে আমাদের সমাজ সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা, ব্যক্তির স্বাধিনতা আরো ব্যাপক পরিসরে বলতে গেলে কবিতার স্বাধীনতা খুঁজতে যাওয়া অহেতুক পরিশ্রম বই কিছু না। নব্বইয়ের যে আন্দোলনকে কবিতা যে মেধা আর শক্তি জুগিয়েছিল আজকে তার আর পারছেনা। কেননা অধিকাংশ সৃজনশীল মানুষ ক্ষমতাবানদের ছকেই পা ফেলছে। নানারকম সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যঘাত ঘটতে পারে তাই মূল সমস্যাতে কেউই কুঠারাঘাত করছে না। এতে করে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।

যা গতানুগতিক তা গল্প হয় না; যা অসামঞ্জস্য তাই গল্প হয় তাই কবি সেই অস্বাভাবিকতা গল্প বলতে চান সবাইকে।

গল্প শোনো, বিষাদ আব্দুল্লাহ’র গল্প

আড্ডার জন্য তুমিই উত্তম...

লাশের সাথে আড্ডা/

বর্তমান সময় নিয়ে কবির যে সংশয় তার প্রতিটা কবিতাতেই স্পষ্ট ছাপ লক্ষ করা যায়। কবি তা জেনে বুঝেই করেছেন। সাধারণের কষ্টে ছারপোকাদের উল্লাস কবিকে আরো বেশি ব্যথিত করে। কিন্তু কবি কান্না করতে পারেন না। কান্না আটকে আসে, কেননা কান্নায় কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই গুমরে উঠেন কবি, গুটিয়ে নেন নিজেকে। কিন্তু কবিকে গুটিয়ে নেয়া মানায় না। হয়তো আমাদের ভুলও হতে পারে। গুটিয়ে নেওয়ার আড়ালে হয়তো শক্তি সঞ্চয় করেন, নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে কবি হয়তো হঠাৎ করেই হুঙ্কার দিবেন। আমরা সেই প্রত্যাশাই রাখি।

মাতাল হাওয়া, জানালার বাহিরে শুকনো পাতার মর্মর নিনাদ

আমি ঠিক শুনতে পাই, চেনা পায়ের শব্দ

গাঢ় ঘুমের স্তরে স্তরে

তার অস্তিত্ব জেগে ওঠে প্রতিমার মতন

অস্তিত্বের খোঁজে/

সরল, কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের খুব গভীরের নগ্নতাকে এভাবে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করবার পাশাপাশি সত্যোচ্চারণের মাধ্যমে ক্ষমতাবানদের শত্রু হয়ে উঠেন।। সমাজের অধিকাংশ মানুষই যখন ক্ষমতাবানদের অন্ধ অনুগামী, প্রবলভাবে তোষামোদকারী, অপরের কৃপাবঞ্চিত হওয়ার আতঙ্কে সত্যানুসরণে অনাগ্রহী, তখন স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চেয়েছেন বিষাদ আব্দুল্লাহ। 

বাতাসের কসাইখানায়

গরীব সম্পদের ভাগবাটোয়ারা চলছে

কেউ কেউ প্রভুদের পা ধুয়ে দিচ্ছে

অন্যরা পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে

সার্কাস/

দেশের মানুষ যখন দারিদ্রের দোলনাচালে বন্দী, সাহেব-মেমদের মধুপিয়াসী নজর যখন অন্য দেশের সম্পদে আর আমাদের নেতা-নেত্রীদের চরিত্রহীন চাটুকারীতা শুধু ক্ষমতায় আরোহন তখন তাঁর কলম আমাদের শিল্পের মানে খুঁজতে বাধ্য করে। কিন্তু জনগণ, হায় বোকা জনগণ বারবার তাদেরই সিংহাসনে বসাচ্ছে। ক্ষমতাবানদের পেট বড় হচ্ছে আর জনগণের ক্ষুধায় বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। তবে পুজিবাদের এই দুনিয়াতে প্রত্যেকটা কবিই ক্ষুধার্ত। একজন না খেয়ে থাকা ক্ষুধার্ত থেকেও বেশি ক্ষুধার্ত। জল খেয়েও ক্ষুধা মেটানো যায় কিন্তু কবির ক্ষুধা কি দিয়ে মিটবে কবি নিজেও ঠিক জানেন না। তাই কবি অবিরত লড়াই করতে চান। 

যদি বলে সে,

আপনার ক্ষুধা আমার চেয়ে ক্ষুধার্ত বেশি!

বলবো, চল্ দু’জনে লড়তে লড়তে মরে যাই...!

সর্বহারা/

অন্য সবার চোখে যা স্বাভাবিক কবির চোখে অন্যভাবে তা ধরা দেয়। সকল কিছুর ভেতরেই খুঁজে ফিরেন অসাধারণ সব চিত্রমালা। সেই চিত্রমালা খুঁজতে খুঁজতে কবি যে সবসময় কোমল-সুন্দর ভাষাই ব্যবহার করেছেন, তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে কঠোর কিংবা রূঢ় শব্দ ব্যবহারেও দ্বিধা করেননি।

হালা অমানুষ! হুদা-ই লারকি দিয়া বুকের বিত্রে ফুঁ মারে, আগুন জ্বলি ওডে। কান্দার বিতরে কেরোসিন মারে, কাইনতে কাইনতে বেহুশ করিআলায়।

ফাকিং মাই মাইন্ড/

কবি বেঁচে থাকেন মূলত তাঁর কাব্যবিন্যাসের স্বকীয়তায়। তাই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সুবিধা পাবার আমায় কবিতা বিবেচনা না করে কোন কোন কবিকে জাতে উঠিয়ে ফেলেন সম্পাদক। একজন যোগ্য স¤পাদক কখনো ব্যক্তির মুখ দেখে নয়; লেখার বহুমাত্রিকতা এবং প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় রেখে তবেই লেখা প্রকাশে উদ্যোগী হন। কবির সাথে হয়তো এমন কিছু ঘটেছে তাই কবি তার ক্ষোভ ধরে রাখতে পারেননি; শেষ কবিতাটিতে আমি দেখতে পাই সাহিত্যের বিস্ময়, ভুল না বললে সেটা পাঠকেরও বিস্ময়। পাঠক মাত্রই মুগ্ধ না হয়ে পারেন না।

তোমার তো প্রকৃত যন্ত্রণা চাই

এই সময়ে,

কবি দেখি কবিতা দেখি না...

কবি দেখি কবিতা দেখি না/

একথার মধ্য দিয়ে কবি যেন তার কবিতার ভাষা দিয়ে আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছেন। এখানে কবির দৃষ্টিভঙ্গি আরো উদার, আরো গভীর হয়েছে। উপলব্ধি অনেক স্বচ্ছ। সাহিত্যের অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে, সেটা কবিতা হোক আর গদ্য সাহিত্য। কবি সেই দায়বদ্ধতার অর্ধেকটা পালন করেছেন; অসঙ্গতিগুলো তুলে এনেছেন ঠিকই কিন্তু সেগুলোর নিরাময়ে যে প্রেসক্রিপশন সেটা কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কবি আশা রাখেন সংকোচ, সংশয় বাদ দিয়ে কেউ না কেউ কখনো না কখনো মোকাবেলা করবে। জন্ম দেবে সুন্দর একটা সময়ের।

সংকোচ, সংশয়ে কিংবা নিরুপায়

সময়ের নাড়ি অস্ত্রোপচার করে কেউ কেউ এখনো

একটি সুন্দর দিন জন্ম দেওয়ার প্রচন্ড তাড়নায়...

কষ্টের শার্ট/

শিরোনামে যে-কথা বলতে চেয়েছিলাম  কবিতা এক সরল-সুন্দর কিন্তু গভীর মায়াময় প্রাণের জগৎ। সর্বোপরি কবিতা হচ্ছে শিল্পের প্রভাববিস্তাকারী শক্তিশালী মাধ্যম। আর তাই কবিতার নান্দনিক অনুভব ছুঁয়ে থাকুক একজন কবির মানসভূগোল। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পথে সে-বলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। সে-চেষ্টা না করে বরং কবির কবিতাপাঠের মোহন আহ্বাণ জানিয়ে আপাত-যবনিকা টানা যাক।

No comments

‘ছাঁট মানুষের জাগ’ অমিত আশরাফের সারৎসার

 আবু জাফর সৈকত ‘ছাঁট মানুষের জাগ’ অমিত আশরাফের সারৎসার ‘ ছাঁট মানুষের জাগ’ কবি অমিত আশরাফের সূচনা গ্রন্থ। কবিতাগুলোতে তারিখ সংযোজন হওয়াতে কব...

Theme images by fpm. Powered by Blogger.